
টাকা দিলেই মেলে কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের ধোয়াপালং ও উখিয়া রেঞ্জে পাহাড় কাটা, বনভূমি দখল, বালু উত্তোলনের অনুমতি। ধোয়াপালং রেঞ্জ কর্মকর্তা রায়হান খান ও উখিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা আব্দুল মান্নানের নেতৃত্বে একের পর এক বনভূমি বেচা-কেনা, পাহাড় কেটে মাটি বিক্রি, বালু উত্তোলন, পাহাড়ে থাকা শত শত মাদার ট্রি কেটে কোটি কোটি টাকা অবৈধ উপার্জনের অভিযোগ উঠলেও থেকে গেছেন ধরাছোয়ার বাইরে।
প্রাপ্ত তথ্য মতে ধোয়া পালং রেঞ্জে প্রায় ২’শ একর বনভূমি রেঞ্জ কর্মকর্তা রায়হান খানকে ম্যানেজ করে অবৈধ দখলে নিয়েছে ভূমিদস্যু সিন্ডিকেট। বনবিভাগের জায়গায় তারা গড়ে তুলেছে অবৈধ স্থাপনা। উত্তোলন করছে মাটি ও বালু। উখিয়ার বড়ইতলী, মধুরছড়া, বায়তুন-নূর আল-ইসলামীয় মাদরাসার পাশে এখনও পাহাড় কাটার কার্যক্রম চলছে। রাজাপালং ইউনিয়ন বড়ইতলী, মধুরছড়া, বায়তুন-নূর আল-ইসলামীয় মাদরাসার পাশের পাহাড় প্রকাশ্যে দিনদুপুরে কাটলেও রহস্যজনক কারণে নিরব রয়েছেন রেঞ্জ কর্মকর্তা আব্দুল মান্নান। ট্রাকে মাটি ভরার পরে সেটা চলে গেলে, আবার আরেকটি ট্রাক এসে মাটি ভরছে। পরে মাটি ভর্তি ট্রাকগুলো রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরের রোড দিয়ে চলে যায়। কেউ তাদের বাধা দিচ্ছে না। রেঞ্জ ও বিট অফিসারগন দেখেও না দেখার ভান ধরে আছে। সহজেই পাহাড় কেটে ট্রাক ভরে মাটি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, এ বিশাল জায়গা দখল করতে এক প্রভাবশালী সিন্ডিকেট ঐ রেঞ্জ অফিসারকে মোটা অঙ্কে ম্যানেজ করে বনাঞ্চলের গাছ উজাড় অব্যাহত রেখেছে। বর্তমানে জবর দখলকৃত বনভূমি প্লট আকারে বিক্রি হচ্ছে। বনের জায়গা দখল ও প্লট আকারে বিক্রিকারী সিন্ডিকেটের সঙ্গে স্থানীয় বন বিটের কতিপয় বনকর্মীর গোপন আঁতাত রয়েছে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, রামুর ধোয়াপালং কমিউনিটি ক্লিনিক ও আবদুল আজিজ মেম্বারের বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়া রাস্তার ২ কিলোমিটার পশ্চিমে বনের জায়গা দখল ও প্লট বাণিজ্য চলছে। পশ্চিম ঘোনার পাড়ার সাইরেরক্লেলা মাঠ, জুমের ছরা, বসু হেডম্যানের নালা, নতুন রাস্তার মুখ এলাকায় বনের জায়গা বিভিন্ন নামে ভাগবাটোয়ারা ও বিক্রির মহোৎসব চলছে।
গত ১ বছর ধরে এই ২ রেঞ্জের কয়েক কোটি টাকার গাছ কেটে স্থানীয় স’মিলে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। বনভূমিকে বৃক্ষ শুন্য করে এখন চলছে বনের জায়গা বিক্রির পালা। সিন্ডিকেড সদস্যরা কোটি কোটি টাকার সরকারী বনভূমি বিক্রি করলেও রহস্য জনক ভাবে বনবিভাগের ধোয়াপালং ও উখিয়া রেঞ্জের বনকর্মীরা নিরব রয়েছে। দখলকৃত বনভূমি থেকে প্রত্যেহ অসংখ্য ডাম্পার ভর্তি মাটি ও বালু উত্তোলন করছে সিন্ডিকেট সদস্যরা। ডাম্পার প্রতি এক হাজার টাকা করে বনকর্মীরা হাতিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সুত্রমতে একের পর এক সংরক্ষিত বনাঞ্চল শূন্য করছে এই ২ রেঞ্জ কর্মকর্তার নেতৃত্বাধীন একটি সংঘবদ্ধ চক্র। শুধু মোছারখোলা বনাঞ্চল থেকেই প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার কাঠ পাচার হচ্ছে। জানা গেছে, উখিয়ার পালংখালীর মোছারখোলার বিট কর্মকর্তা বেলাল হোসেন সহ বিট অফিসটি আগাগোড়া একটি দুর্নীতির আখড়া। পানের বরজ থেকে সবজী ক্ষেত পর্যন্ত সব কিছুতেই চলে তার ভয়াবহ বাণিজ্য। বন রক্ষার নামে প্লট বানিয়ে বনের জমি বিক্রি, টাকার বিনিময়ে অবৈধ দখলদারদের পাকা দালান নির্মাণের সুযোগ, পাহাড় কেটে মাটি-বালু বিক্রি বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থ কামাতেই সময় পার করেন কর্মকর্তারা। বনের জমি দেখভাল করার দায়ীত্ব তাদের থাকলেও উল্টো বনের জমি বাণিজ্যে লুটপাট চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। সুত্রে জানা যায়, ২০২৪-২০২৫ সালের হেল্প প্রজেক্টে কাগজে-কলমে ১৫০ হেক্টর থাকলেও সম্পূর্ন বাগান না করে সিংহভাগ টাকা আত্মসাতের অভিযোগও রয়েছে। মোছারখোলা বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, চারদিকে বড় বড় পাহাড়ের টিলা আর সারি সারি গাছ এবং তার ভেতরে নতুন নতুন ঘর-বাড়ি। নতুন নতুন টিনের ঘর আর দালানে ভরে গেছে পুরো বনভূমির জায়গা। দেখলেই মনে হয় এ যেন নতুন একটি গ্রাম। এটি বন বিভাগের সংরক্ষিত বনভূমি বলে ধারণা করাটাও ভুল হবে বলে জানান স্থানীয় অনেকে। প্রভাবশালী ব্যক্তিরা রেঞ্জ ও বিট কর্মকর্তার সাথে যোগসাজশে টাকার বিনিময়ে জমিগুলো সামাজিক বনায়নের নামে দখলে নিয়ে সেখানে নির্মাণ করছেন বড়বড় দালান ও আধাপাকা ঘরবাড়ি। এতে করে সামাজিক বনায়নের নাম করে দিন দিন দখল হয়ে যাচ্ছে বনভূমি। ২০২৩-২০২৪ সালের সুফলের ১৯০ হেক্টর বনায়ন কাগজে-কলমে থাকলে বনভূমিতে তা শুন্য। ২০২৩-২০২৪ সালের বাগানের কোন আগাছা পরিষ্কার করেনি বরং আগাছা পরিষ্কারের বাজেটের টাকা গুলো পকেটে ঢুকিয়েছেন কর্মকর্তাগন এমনটাই জানিয়েছেন স্থানীয় পরিবেশপ্রেমীরা। নিয়ম অনুয়ায়ী সুফল বা হেল্প প্রজেক্ট এলাকায় বাগানের বরাদ্ধ সহ যাবতীয় বর্ননা দিয়ে সাইনবোর্ড স্থাপনের বিধান থাকলেও সরেজমিনে কোন সাইন বোর্ড দেখা যায়নি।
একজন সদ্য অবসরে যাওয়া এক বন কর্মকর্তা জানান, উখিয়া রেঞ্জে দায়িত্ব গ্রহণ ও দায়িত্ব পালনকে কেন্দ্র করে বন বিভাগে একাধিক অনিয়ম ও ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে বর্তমানে পদোন্নতি প্রাপ্ত ডেপুটি রেঞ্জার আব্দুল মান্নান’র বিরুদ্ধে। বিভিন্ন সূত্রের দাবি, রেঞ্জ প্রশিক্ষণ আসা রেঞ্জ কর্মকর্তা মো: শাহিনুর ইসলাম (৪১তম বিসিএস) ছয় মাসের প্রশিক্ষণে গেলে তাঁর অনুপস্থিতিতে রেঞ্জের দায়িত্ব পেতে তিনি তৎকালীন বিভাগীয় বন কর্মকর্তা নুরুল ইসলামকে ১০ লক্ষ টাকা ঘুষ প্রদান করে বাগিয়ে নেন উখিয়া রেঞ্জ।
কেবল উখিয়া নয় মান্নান অতীতে বন বিভাগের বিভিন্ন ডিভিশনে কর্মরত থাকা অবস্থায়ও অবৈধ কাঠ বিক্রি, বাগান ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি এবং ভোলা বন বিভাগ থেকে বান্দরবান বন বিভাগ পর্যন্ত বহুমুখী অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
ভোলা বন বিভাগে দায়িত্বে থাকা অবস্থায় সংরক্ষিত গাছ পাচার ও বিক্রির সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয় এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়।
বান্দরবান বন বিভাগের ডিএফও আব্দুর রহমানের সঙ্গে যোগসাজশে ১৫ লক্ষ টাকার বিনিময়ে পাইন্দু রেঞ্জের দায়িত্ব নেন। পরবর্তীতে ভূয়া জোত পারমিট ইস্যুর মাধ্যমে সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে মূল্যবান গাছ কেটে পাচার করে প্রতি ঘনফুট কাঠের জন্য তখন ৬১ টাকা করে অবৈধ আদায় করা হতো যার সিংসভাগ অর্থাৎ ৩৫ টাকা প্রতি ফুট হিসাবে দিতে হতো বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আব্দুক রহমানকে।
এছাড়া কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের উখিয়া রেঞ্জে হেল্প প্রকল্পের বাগান রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বরাদ্দ ৭৫ লক্ষ টাকা উত্তোলনের পর ৩৫% দেওয়া হয় সাবেক ডিএফও নুরুল ইসলামকে, আর বাকি অর্থ আত্মসাৎ হয়েছে বলে একাধিক সূত্র দাবি করেছে। যদিও অভিযোগ অনুযায়ী, সহকারী বন সংরক্ষক শাহিনুর ইসলামের সৃজনকৃত বাগানটি যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি।
উখিয়া রেঞ্জের এক ফরেস্ট গার্ড নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “টাকা দিলেই রেঞ্জে পাহাড় কাটা যায়, জমি দখল করা যায়, বালু উত্তোলনের অনুমতি পাওয়া যায়। কাঠ পাচারের ক্ষেত্রেও বড় অঙ্কের টাকার লেনদেন হয়।” স্থানীয় সচেতন মহল ও বন সুরক্ষা কার্যক্রম সংশ্লিষ্টরা এসব অভিযোগের স্বচ্ছ তদন্ত ও দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন

পাঠকের মতামত